সালেম রাজ্য  -আবদুল্লাহ আন নাবিল

সালেম রাজ্য -আবদুল্লাহ আন নাবিল

তোমাদের গল্প জুলাই ২০১৮

জঙ্গলে পা দিয়েই শিহরিত হলো তারা। জঙ্গলটা মাহি ও সিয়ামদের বাড়ির কাছেই। এটা নিয়ে নানা জনশ্রুতি আছে। কেউ জঙ্গলটির ভেতর যায় না। তারাও এর আগে কখনো যায়নি। দু’জনে মিলে পরিকল্পনা করেছে এবার তারা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সাথে কিছু শুকনো খাবার ও একটি করে লাঠি নিয়ে প্রবেশ করলো জঙ্গলে। তখন মাত্র সূর্য উঠেছে। ফজর পড়েই রওয়ানা দিয়েছে তারা।
সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলো দুজন। তাদের দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেল নানারকম প্রাণী। লতা-পাতার বাধা এলে তা সরিয়ে দিলো লাঠি দিয়ে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর তারা দেখতে পেল একটা বড় পুকুর। পুকুরের দুপাশে দুটি ঘাটলা ও সাথে বসার স্থানও দেখতে পেল। যেগুলো নানারকম লতা-পাতায় পূর্ণ। এখানে এসব দেখে বেশ অবাক হলো তারা। লতা-পাতা সরিয়ে পরিষ্কার করে একটাতে বসলো দুজন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠার সময় মাহি লক্ষ করলো পুকুর থেকে কিছুটা দূরে ঘরের মতো কি যেন দেখা যাচ্ছে। গাছগাছালি আর লতা-পাতায় ঢেকে থাকায় বুঝা যাচ্ছে না। সিয়ামকে বলতেই সে বললো, ‘চলতো, দেখি।’ তারা কাছে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো এটা একটা মসজিদ। মসজিদটা বেশ বড়। মসজিদের আশপাশে কিছুটা দূরে ঘুরতে গিয়ে দেখলো সেখানে কিছু পুরাতন দালানের ধ্বংসাবশেষ। গাছ-গাছড়ার কারণে তা ভালো করে বুঝা যায় না। এসব দেখে বেশ অবাক হলো তারা। জঙ্গলের মধ্যে এসব এলো কিভাবে? তবে বুঝতে পারলো এখানে আরো অনেক আগে একটি জনপদ ছিল। তখনকার যুগের দালান-কোঠাও ছিল। যেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। পরিত্যক্ত থাকার কারণে সব ঢেকে গিয়েছে গাছ-গাছড়ায়। তারা আসার সময় পথে ছোটখাটো কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখেছিল। হয়তো এরকম আরো অনেক ছিল। গাছ-গাছড়ায় ঢেকে থাকার কারণে তা দেখা যায়নি। মসজিদটিতে ভাঙার কোন চিহ্ন নেই। অব্যবহৃত থাকায় গাছ-গাছড়া উঠে এ অবস্থা।
মসজিদে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলো তারা। লতা-পাতা সরিয়ে মসজিদের দরজার সামনে এলো। দরজা-জানালার কাঠের কিছুই হয়নি। এখন পর্যন্ত অক্ষত। দরজাটা খুলে সরে দাঁড়ালো সামনে থেকে। কারণ কতকাল বায়ু এ স্থানে বদ্ধ অবস্থায় আছে কে জানে? এমন বায়ু বিষাক্ত। কিছুক্ষণ পর জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তারা। ঘুরে ফিরে দেখলো মসজিদটা। যেন কোন শাহি মসজিদ। ভেতরে একটা কাঠের আলমারি ও কাঠের মিম্বর দেখতে পেল। সবই অক্ষত। খুলতে চেষ্টা করলো আলমারিটা। পারলো না। পর্যবেক্ষণ করে দেখতে লাগলো খোলার কোনো উপায় আছে কিনা। আলমারির উপরের অংশে চারটা কাঠের বোতাম দেখতে পেল। প্রথমটার উপরে লেখা আলহামদুলিল্লাহ্, দ্বিতীয়টাতে বিসমিল্লাহ্, তৃতীয়টাতে ইনশাআল্লাহ্ আর চতুর্থটাতে সুবহানআল্লাহ। বোতামগুলোর নিচে লেখা, সঠিক ক্রমানুযায়ী বাছাই করো। ভাবতে লাগলো তারা। কিছুক্ষণ পর সিয়াম প্রথমে চাপ দিলো দ্বিতীয় বোতামে (বিসমিল্লাহ্) তারপর চতুর্থ বোতামে (সুবহানাল্লাহ) এরপর প্রথম বোতামে (আলহামদুলিল্লাহ্) আর সবশেষে তৃতীয় বোতামে (ইনশাআল্লাহ)। খুলে গেলো আলমারি। ভেতরে পেল কয়েকটি কুরআন শরিফ, কয়েকটি হাদিস খণ্ড ও একটি বাক্স। খুললো বাক্সটি। পেল একটি চিঠি আর একটি কাগজ।
চিঠিটি পড়তে শুরু করলো মাহি, “আমি মুহাম্মদ আবু সুলায়মান। এই মসজিদ তথা ‘দারুস সালাম জামে মসজিদের’ একজন খাদেম। আমি মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করতাম। মসজিদটি ছিল আমাদের ‘সালেম’ রাজ্যের প্রধান মসজিদ। মসজিদের পাশেই ছিল রাজ্য পরিচালনার ভবন ও বিচারালয়। আমরা বাস করতাম অনেক সুখে-শান্তিতে। কারণ আমাদের রাজ্য ছিল সম্পূর্ণভাবে ইসলাম অনুযায়ী পরিচালিত। আমাদের রাজ্য এভাবে চললেও অন্যরা ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ায় পতন ঘটতে লাগলো তাদের। একসময় প্রতারক ইংরেজরা দখল করে নিলো মুর্শিদাবাদ, পতন হলো নবাবের। আমরা ছিলাম যার করদ রাজ্য। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলাম আমরা। অন্যান্য রাজ্যের জনগণকে সচেতন করে তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে লাগলাম। আমাদের দমন করতে বাহিনী পাঠালো ইংরেজরা। খবর পেয়ে সবাই যুদ্ধ করতে চললো ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইংরেজরা আগে এসে লুকিয়ে রইলো পথের পাশে। আসার পথে হঠাৎ আক্রান্ত হলো আমাদের বাহিনী। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইংরেজরা হামলা চালালো অতর্কিত। হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ায় বীর-বিক্রমে যুদ্ধ করলেও সুবিধা করতে পারলো না আমাদের বাহিনী। ইংরেজদের কামান ও বন্দুকের আঘাতে শহীদ হয়ে গেলো সবাই। এরপর ইংরেজ বাহিনী চড়াও হলো আমাদের রাজ্যের ওপর। কামান দাগিয়ে ধ্বংস করে দিলো সব বাড়িঘর। শহীদ হলো তাতে থাকা সব নারী, শিশু ও অক্ষম ব্যক্তিরা। এ নির্মম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর তারা লুট করতে এলো রাজ্য পরিচালনার ভবন। মনে করেছিলো অজস্র ধনভান্ডার পাবে তাতে। কিন্তু না। তারা কিছুই পেল না।
যুদ্ধে রওয়ানার সময় রাজ্যের কোষাগারের সম্পদ ছাড়াও ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য জনগণের দেয়া অজস্র ধন-সম্পদ, স্বর্ণ-রৌপ্য। যার যা সম্ভব সে তাই দিয়েছিল। কিন্তু তা দিয়ে রসদপত্র কিনার আগেই এসে পড়ে ইংরেজ বাহিনী। যুদ্ধে হারলে তারা এ সম্পদ লুট করতে পারে এ চিন্তা থেকে তা রাখা হয় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ গোপন স্থান মসজিদের আন্ডারগ্রাউন্ডে। যেখানে ঢোকার নকশা চিঠির সাথে রাখা কাগজে দেয়া আছে।
ইংরেজরা ধন-সম্পদ না পেয়ে ধ্বংস করে দিলো রাজ্য পরিচালনার ভবন। কিন্তু তারা মসজিদে হাত দিতে সাহস পেল না। তাদের মনে ভয়ছিল যে এতে তাদের ওপর গজব নাজিল হতে পারে। এ ধ্বংসযজ্ঞের সময় মসজিদে থাকায় বেঁচে গেলাম আমি। কিন্তু আফসোস যে ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকানোর কোন উপায়ই আমার ছিল না।
এ ধ্বংসযজ্ঞের কথা গোপন করতে এক অভিনব ব্যবস্থা নিলো ইংরেজরা। তখন মাত্র বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। তারা রাজ্যের সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলো বিভিন্ন গাছের বীজ। তা থেকে গাছ হয়ে আবার সেগুলো বংশ বিস্তার করে আমাদের রাজ্যকে পরিণত করলো একটি জঙ্গলে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি জনপদের চিহ্ন।
চিঠিটি এ জন্য লিখে রাখলাম যদি আল্লাহর কোন বান্দা এখানে আসেন তাহলে তিনি যেন এর ইতিহাস জানতে পারেন।”
বিস্ময়াবিষ্ট চেহারা নিয়ে মাহি ও সিয়াম তাকালো একে অপরের দিকে। তারপর তুলে নিলো চিঠির সাথে থাকা কাগজটি। তাতে একটি মসজিদের চিত্র আঁকা। তার মধ্যে লেখা কুরআনের আয়াতাংশ, “ইন্না আকরামাকুম ইনদাল্লাহি আতক্বকুম” আর তার নিচে লেখা,
মাথায় থাকে জ্ঞান,
পায়ের নিচে ধন।
এর অর্থ বের করতে ভাবতে লাগলো তারা। কিছুক্ষণ পর মাহি বললো, ‘মসজিদটি নিশ্চয়ই এই মসজিদ হবে। চিঠি থেকে তাই বুঝা যায়। আর আয়াতাংশটির অর্থ হলো, ‘নিশ্চয়ই সে সবচেয়ে সম্মানিত, যে সর্বাধিক তাকওয়াবান।’ মসজিদে ইমাম সাহেবই সবচেয়ে সম্মানিত। সুতরাং আয়াতাংশ দ্বারা ইমাম সাহেবকে বুঝানো হয়েছে। তার নিচে লেখা,
মাথায় থাকে জ্ঞান, পায়ের নিচে ধন।
অর্থাৎ এগুলো লুকানো আছে ইমাম সাহেবের পায়ের নিচে। ইমাম সাহেব খুতবা দেন মিম্বরে। সুতরাং ইমামের পায়ের নিচে মানে মিম্বরের নিচেই আছে এর পথ।’
এবার দু’জন গেল মিম্বরের কাছে। তুলে রাখলো একপাশে। দেখলো মিম্বরের নিচের অংশও মসজিদের মেঝের মতোই। পথটা নিশ্চয়ই এখানে এবং তা খোলার অবশ্যই কোন পথ আছে ভেবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তারা। দেখতে পেল পাঁচটি বোতাম। যা মেঝের সাথে প্রায় মিশে আছে। খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ না করলে বুঝাই যায় না।
প্রথম বোতামে লেখা সূরা ইয়াসিনের নাম, দ্বিতীয় বোতামে সূরা আন-নিসার নাম, তৃতীয় বোতামে সূরা ইখলাসের নাম, চতুর্থ বোতামে সূরা ফাতিহার নাম আর পঞ্চম বোতামে সূরা দুখানের নাম। নিচে লেখা অধিক মর্যাদাপূর্ণ তিনটি সূরা বাছাই করো কুরআনের ক্রমানুসারে।
প্রথমে চাপলো চতুর্থ বোতামে (সূরা ফাতিহার নাম) তারপর প্রথম বোতামে (সূরা ইয়াসিনের নাম) এরপর তৃতীয় বোতামে (সূরা ইখলাসের নাম)। খুলে গেল আন্ডারগ্রাউন্ডের পথ। বিসমিল্লাহ্ বলে সিঁড়ি বেয়ে নামলো নিচে। পেল অনেকগুলো সিন্দুক। প্রতিটিতে স্বর্ণ-রৌপ্য, তৎকালীন মুদ্রা ইত্যাদি ধনসম্পদে পূর্ণ। একটিতে পেল একটি চিঠি। পড়তে শুরু করলো চিঠিটা,
চিঠির শুরুতে তায়াউজ (আউজুবিল্লাহ) ও তাসমিয়ার (বিসমিল্লাহ) পর আল্লাহ তায়ালার হামদ এবং রাসূলের প্রতি দরূদ ও সালাম। তারপর মূল চিঠি...
“আজ আমরা এসব ধনসম্পদ এখানে রেখে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এসব ধনসম্পদের বিরাট অংশ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য রাজ্যের জনগণ জমা দিয়েছে। ইংরেজরা দ্রুত বাহিনী পাঠানোর কারণে যা কাজে ব্যবহার করতে পারিনি। নিরাপত্তার জন্য এগুলো রেখেছি এখানে। যদি আল্লাহ আমাদের গাজী হিসেবে ফিরিয়ে আনেন তাহলে আমরা এ সম্পদ ব্যবহার করবো ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য। আর যদি শহীদ হয়ে যাই তাহলে ইংরেজরা হয়তো ধ্বংস করে ফেলবে আমাদের রাজ্য। কিন্তু মসজিদে হাত দেয়ার সাহস হবে না তাদের। তাতে হয়তো বহু বছর পর আল্লাহ তার কোন বান্দাকে দিয়ে এ সম্পদ উদ্ধার করাবেন, ইনশাআল্লাহ্। আমাদের ইচ্ছা তারা যেন এ সম্পদ ইসলামের যথার্থ জ্ঞান শিক্ষা দিতে ও তা প্রচারে ব্যয় করেন। কারণ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলেই ইংরেজদের হাতে পতন হয় দেশের স্বাধীনতার। এ জ্ঞান পেলে সচেতন হবে মুসলমানরা এবং সক্ষম হবে নিজেদের উন্নতি করতে।
আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, আমরা যদি শহীদ হয়ে যাই তাহলে তিনি যেন এ সম্পদ যোগ্য মুসলমানের দ্বারা উদ্ধার করে তা যথাযথ ব্যবহারের তাওফিক দান করেন। (আমিন)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ