সুষমা এবং কামরাঙা গাছ

সুষমা এবং কামরাঙা গাছ

গল্প জানুয়ারি ২০১৩

তমসুর হোসেন..

স্কুল থেকে যে কামরাঙা চারাটি গত বছর এনেছিল সুষমা এবার তাতে ফুল ধরেছে। স্যারের কথাই ফলে গেল। স্যার বলেছিল, সামনের বছর এতে ফুল ধরবে। ফুল দেখে সুষমার যে কী আনন্দ লাগছে! ঝাঁকালো সবুজ পাতার আড়ালে গাঢ় বেগুনি ফুল। তার ভেতর থেকে ঝরনা কলমের নিবের মত দু-একটা সবজেটে ফল উঁকি দিচ্ছে। পড়ার টেবিলে মোটেই থাকতে পারছে না সুষমা। তার মন চাচ্ছে সারাদিন গাছের নিচে বসে থাকবে। মাকে হাত ধরে টেনে এনে সে রঙিন ফুল দেখায়। রুণি ফুফুকে নিয়ে ঘন ছায়ায় বসে বউসুন্দরী খেলা করে। তাতেও সখ মেটে না সুষমার। গাছের নিচে বিছানা পেতে নরম বালিশে মাথা রেখে শুয়ে থাকে সে। পাতার ফাঁক দিয়ে সে শরতের নীল ভেজানো আকাশ দেখে। সাদা মেঘরা দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। উপরে মনে হয় ঝুলে আছে একটা নীলের সমুদ্র। মেঘের ভেলায় চড়ে উড়ে বেড়াতে মন চায় সুষমার। গতবারের লাগানো গাছটা! ঘন পাতায় কেমন করে শাখা ঢেকে গেছে। কখন যে টুনটুনিরা এসে তার ডালে বাসা বেঁধেছে টেরই পায়নি সুষমা। লুকানো বাসায় একটা ছোট্ট পাখিকে ঢুকতে দেখে অবাক হলো সে। সুষমার বুকের ভেতর অনেক ঢেউ লাফাতে লাগল। মনে হলো তার চোখের সামনে অসংখ্য সাদা পায়রা দাফিয়ে বেড়াচ্ছে। মাকে ডাকতে লাগল সেÑ আম্মু দেখে যাও, কী মজার কাণ্ড হয়েছে! আমার গাছে এসে পাখি বাসা তৈরি করেছে। আম্মুর কোনো সাড়া না পেয়ে তাকে খুঁজতে লাগল সুষমা। ওকে ব্যস্ত দেখে রুণি বলল, কী হয়েছে সুষমা, আমাকে বল না সোনা। খিদে পেয়েছে? চল মুড়ি দিয়ে ঝালচানা খাই। আমার কাছে প্রাণ ফ্রুটি আর ললিপপ আছে। খাবে এখন মজা করে। কিছুই ভালো লাগছে না সুষমার। তার গাছে টুনটুনি বাসা করেছে। মাকে না দেখিয়ে সে একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না। অন্য সময় হলে সে রুণির পেছনে আটার মতো লেগে যেত। টকঝাল লজেন্স নিয়ে দুই গালে দুটো ঢোকাত। হাতের পিঠে ক্যান্ডি লোগো লাগিয়ে পকেটে আচাড় পুরে তবে ছাড়ত। এখন রুণির কথা তার যেন কানেই যাচ্ছে না। পাথরের মত শক্ত হয়ে বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মা যতই তাকে বলছে, রুণির সাথে খেল গিয়ে। আমি কাপড় কেচে গায়ে পানি ঢেলে যাচ্ছি। সে কথা শুনছে না সুষমা। সে শুধু বলছে, ওসব পরে কর। এখন জলদি আস। একদম দেরি কর না। মঞ্জু মেয়েকে জানে। যা জিদ ধরবে তাই করে ছাড়বে। তোয়ালেয় হাত মুছে বাথরুম থেকে বের হয় সে। গরমে গা ঘেমে গেছে। কত কাজ পড়ে আছে। কখন করবে ওসব! মাকে নিয়ে গাছের নিচে আসে সুষমা। চোখ দুটো তার জলের তরঙ্গে নাচছে। মাকে দেখাল সে পাখির বাসা, আমার গাছে কী সুন্দর বাসা বেঁধেছে পাখি। তুমি এখানে বসে থাক দেখবে ওরা এসে বাসায় ঢুকবে। মঞ্জু দেখল বাসাটা। সত্যি তো! সে তো কখনই খেয়াল করেনি। দিনে কতবার গাছতলা ঝাট দিয়েছে। কখনও চোখে পড়েনি। বাসার ভেতরটা বড়ই তুলতুলে। কী মায়াবী দুটো ডিম পড়ে আছে মাঝখানে। অন্য কেউ টের পায়নি এসব। অথচ এই কথাবুড়ি সুষমা কুতকুতে চোখে কী খেয়ালই না করেছে! কোলে নিয়ে ওকে ডিম দেখাল মঞ্জু। ওর তো খুশিতে দম বন্ধ হবার দশা। জিদ করে ডিমটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে তবেই ছাড়ল। ওকে ডিম নাড়তে দেখে রুণি বলল, ওমা আকাশকে ডিম দেখাচ্ছ! আকাশ দেখলে ডিম নষ্ট হয়ে যাবে। একদম ফুটবে না। রুণির কথা শুনে চট করে ডিমটা লুকিয়ে ফেলল সুষমা। সাবধানী চোখে উপরে-নিচে তাকিয়ে বলল, আম্মু আকাশ একদম দেখতে পায়নি ডিমটা। আমি হাতের তলায় লুকিয়ে ফেলেছি। আম্মু, ডিম নষ্ট হয় কেন আকাশ দেখলে? সুষমার নিকট থেকে ওটা নিয়ে খুব যতেœর সাথে বাসায় রাখল মঞ্জু। তারপর মেয়ের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, কাউকে যেন বল না এখানে বাসা করে পাখি ডিম দিয়েছে। পলক আর সুজন জানলে তবে হয়েছে। কোন সময় যে বাসাটাই ভেঙে নিয়ে যাবে টেরই পাবে না। ওদের সামনে পাখির কথা একদম মুখে আনবে না। মা চলে গেলে রুণির কোলে বসে পাখির গল্পে মেতে উঠল সুষমা। শোন রুণিফু, কাউকে বল না যেন। রুণিফু, আকাশের কি চোখ আছে? মা অমন করে বলে কেন, আকাশ দেখলে ডিম ফুটবে না? ওর কথা শুনে রুণি বলে, ভাবী তো সত্যি কথা বলেছে। কেন তুমি জান না? আমরা যাকে তারা বলি ওগুলো তার চোখ। দিনের বেলা সূর্যের তাপে ওর চোখ বন্ধ হয়ে যায়। রুণির কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যায় সুষমা। রাতে তো আকাশ ডিম দেখে ফেলতে পারে। তখন বাচ্চা হবে কী করে! বিকেলে রুণি পড়তে যায় অঙ্ক স্যারের কাছে। সুষমা বায়না ধরল সে-ও যাবে তার সাথে। পাখির জন্য সে মশারি কিনে আনবে। রাতে মশারি দিয়ে বাসা ঢেকে দিলে আকাশ দেখতে পাবে না। রুণি বলল, সোনামা, স্যারের কাছে পড়ে এসে বাজারে যাবো তোমাকে নিয়ে। এখন দাদীর কাছে বসে পাখির গল্প বল। তোমার দাদী অনেক ভালো ভালো গল্প জানেন। কিন্তু সুষমা নাছোড়। সে অনুর সাথে যাবেই। বেশত ফ্যাসাদে পড়ল সে। ওদিকে ওর পড়ার সময় চলে যাচ্ছে। রুণি ভেজা গলায় বলল, আমি ভেবে দেখেছি মশারি দিলে পাখিরা উড়ে যাবে। ডিমে তা না দিলে এমনিই তো পচে যাবে। রাতের বেলা পাখিরা পাখা দিয়ে ডিম ঢেকে রাখে। এখন হলো তো। ডিম নিয়ে আর কোনো টেনশন নেই। তুমি বরং ওদের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে পার। রুণির কথাটা বেশ পছন্দ হলো সুষমার। কত পাখি বাসা বেঁধে ডিম দেয়। অত মশারি কে দেবে তাদের? ওদের তেঁতুলগাছে তো কাক, ঘুঘু, আর শালিকেরা বাসা তৈরি করে বাচ্চা ফুটাচ্ছে। ওদের জন্য মশারি কিনতে তো বেশ ঝামেলা হবে। থাকগে ওসব। একটা তিড়িং নাচ দিল সুষমা। মাকে বলে নুডল্স নিয়ে গোল বাটিতে করে গাছের নিচে রাখল। তেলাপোকা ধরে এনে লাল সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে দিল ডালে। ছন-বাবরি, ঝালমরিচ, মুড়ি, বুট, চাল কত কী রাখল ওদের দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে। কাপে করে পানিও রাখল সে। সারাটা দিন ওরা কোথায় খাচ্ছে না খাচ্ছে। যখন ক্ষুধা পাবে তখনই যেন খেতে পারে। কিন্তু পাখিরা এদিকে একদম দেখছে না। আপন মনে যাচ্ছে আসছে। কেন খাচ্ছে না তারা ওর দেয়া খাবার? কেন ওরা তাকে বন্ধু ভাবতে পারছে না? মুখ গোমড়া করে কাঁদতে লাগল সুষমা। রুণি ফিরে এসে ওর এ অবস্থা দেখে বুকে জড়িয়ে নিলো। রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছে বলতে লাগল, এ বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন! কেউ তোমাকে মেরেছে? ভ্যাঁ করে কেঁদে সুষমা বলল, পাখি কেন ওসব খাবার খায় না। আমি ওদের কী করেছি! রুণি বলল, এ জন্য! আচ্ছা, পাখি বুঝি ঝালচানা খায়? এই মেয়ে, তুমি বুঝি নুডল্স দিয়ে কেঁচো খাবে? ওদের খাবার ওরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। চলতো দেখি, ধানখেতে প্রজাপতির মথ পাওয়া যায় নাকি? ওরা মথপোকা খেলেও খেতে পারে। অনেক কষ্ট করে ওরা দুটো মথ ধরল। এ কেমন পাখি! মথের দেহে সখ করে একটা ঠোকরও দিল না। বাবা অফিস থেকে বাসায় এলে বায়না ধরল সুষমা। বাজার থেকে পাখির জন্য ভালো খাবার এনে দিতে হবে। এমন খাবার যা পাখিরা না খেয়ে পারবে না। আজ রাতে সে রুণিফুর সাথে শোবে। প্রতিদিন সে দাদীর কাছে শোয়। দাদী তাকে অনেক গল্প শোনায়। সেসব গল্প শুনে সুষমা ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। আজ সকাল সকাল খেয়ে গালে চকলেট পুরে সুষমা উদগ্রীব হয়ে ওঠে গল্প শোনার উল্লাসে। রুণি বলল, এখান থেকে অনেক দূরে ফুলমতি গ্রামের কাছে দেউলা নামে একটা বিল আছে। সেখানে মিজোরাম পাহাড় থেকে প্রতিদিন একটা বিরাট পাখি উড়ে আসে। অমন পাখি কোথাও কেউ দেখেনি। লম্বা দুটো পা আর ইয়া বড় ঠোঁট দিয়ে সে বিলের বড় বড় ঝিনুক আর সাপ- কেঁচো ধরে খায়। একদিন একটা সাপের মাথায় যেই সে পাখিটা ঠোকর দিয়েছে অমনি সাপটা তার পা পেঁচিয়ে ধরেছে। পাখিটাও কম যায় না। সে সাপটাকে নিয়ে আকাশে উড়াল দিল। উড়তে উড়তে সে গিয়ে একটা পাহাড়ের চূড়ায় বসল। পাখির ছানারা সাপ দেখে সে কী খুশি! বিলের কাছে নির্জন বাড়িতে যে দাড়িপাকা বুড়োটা থাকে তার কাছে রুণি শুনেছে এ গল্পটা। রুণির চোখে ঘুম আসছিল। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। সুষমা তাড়া দিয়ে বলল, পাখির বাচ্চারা সাপটাকে কী করল রুণিফু, টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল নাকি? তা তো অবশ্যই। পাথরের ওপর বসে সে কী খাওয়া! পাখির গোশত খেয়ে পাখির বাচ্চারা মনের আনন্দে নাচতে লাগল। ঘুমের ঘোরে সারারাত সাপ আর পাখির স্বপ্ন দেখল সুষমা। কালো রঙের অসংখ্য পাখি আর গায়ে চক্কর টানা বিষধর সাপ দেখে ভয়ে সে কুঁকড়ে গেল। সকালে জ্বর উঠল তার গায়ে। সারা শরীরে প্রবল ব্যথা হলো তার সাথে। জ্বর এবং ব্যথায় বেশ কাহিল হলো সুষমা। সুষমার জ্বরের কথা শুনে সজল মামা এলো। মেডিক্যাল কলেজ থেকে মামা এবার ডাক্তারি পাস করেছে। জ্বর মেপে নাড়ি ধরে মামা ঔষধ খাইয়ে দিল। আর বারবার নিষেধ করল সুষমা যেন রোদে না যায়। কামরাঙা গাছটার নিচে কতটুকুই বা ছায়া পড়ে। তার নিচে খেলতে যেয়ে সুষমা রোদে ভাজা হয়েছে। মামার কড়া নজরদারি আর মায়ের যতেœ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠল সুষমা। সুষমার জ্বর ভালো হলে টুনটুনির কথা মনে পড়ল। উঠানে দাঁড়িয়ে সে দেখল তার কামরাঙা গাছটা শরতের মিষ্টি রোদে গোসল করছে। এদিকে টুনটুনির ডিম থেকে দুটো কচি ছানা বের হয়েছে। সুষমার মনটা নতুন দিনের ছোঁয়ায় উল্লসিত হয়ে উঠল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ