স্বাধীনতা ! স্বাধীনতা

স্বাধীনতা ! স্বাধীনতা

প্রচ্ছদ রচনা মার্চ ২০১২

মাহবুবুল হক..

স্বাধীনতা আল্লাহর দান। মানুষকে আল্লাহতায়ালা স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। পরাধীন করেননি। মানুষের সামনে ভালো ও মন্দ পথ তুলে ধরেছেন। ভালো হতে বলেছেন। ভালো হলে পুরস্কার পাবেন- তাও বলেছেন। মন্দ পথ পরিহার করতে বলেছেন- সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, মন্দ পথে চললে অকল্যাণ হবে, কষ্ট হবে, শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু তাই বলে ভালো পথে থাকার জন্য মানুষকে বাধ্য করেননি। যে কোনো পথ বেছে নেয়ার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষ নিজ ইচ্ছায় ভালো বা মন্দ পথ বেছে নিতে পারে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বারবার বলেছেন, ক্রীতদাস মুক্তিতে যারা কাজ করবে, সাহায্য করবে, তারা সবচেয়ে বড় পুণ্যের কাজ করবে। অর্থাৎ পরাধীন মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। মানুষকে স্বাধীন করতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা) এবং তাঁর মহান সাথীরা ক্রীতদাস মুক্তির কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
বলা হয়ে থাকে ক্রীতদাসপ্রথা বিলুপ্ত করেছেন মহান রাসূল মুহাম্মদ (সা)। এখানেই আমরা স্বাধীনতার মহান চেতনার কথা উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা) মানুষকে দাস হিসেবে দেখতে চাননি। দেখতে চেয়েছেন স্বাধীন ও সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে। আল্লাহ নিজে স্বাধীন। তাই তাঁর প্রতিনিধি মানুষকে তিনি স্বাধীন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
স্বাধীন মানুষ বা মানবগোষ্ঠী কোনো কোনো সময় স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। পরাধীন হয়ে যায়। জাতিগতভাবে দাসে পরিণত হয়। ক্রীতদাসে পরিণত হয়। দুর্ভাগ্য, আমরাও তাই হয়েছিলাম।
১৭৫৭ সালে আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছি। স্বাধীনতা হারিয়ে ইংরেজদের দাসে তথা গোলামে পরিণত হয়েছিলাম। সেই গোলামি থেকে মুক্তি পেতে দুই দু’বার আমরা স্বাধীন হয়েছি। একবার ১৯৪৭ সালে। আরেকবার ১৯৭১ সালে।
এটা স্বস্তির বিষয় যে, স্বাধীনতা লাভের জন্য আমাদেরকে বহু যুগ অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমরা ‘এক পাকিস্তান’ নিয়েই স্বপ্ন দেখেছি। পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য সবাই মিলে কাজ করেছি। ’৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বাধালো। ১১ দিন যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে পাকিস্তানের সব অঞ্চলের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আজকের বাংলাদেশ, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলো। বিমানযুুদ্ধে বাঙালিসেনারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। সারা দুনিয়ার মানুষ দেখলো পাকিস্তানিরা এক ও অভিন্ন।
১৯৬৬ সালে শুরু হলো স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলার মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। পুরো পাকিস্তানকে শাসন করার অন্যতম অধিকার পূর্ববাংলার তথা বাঙালির। পাকিস্তানের রাজধানী থাকার কথা ঢাকায়। কিন্তু হিসাব কষে দেখা গেল ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানকে অন্যায়ভাবে শাসন করছে পাঞ্জাবের আমলা, ব্যবসায়ী এবং এর সাথে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারিগোষ্ঠী। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একাট্টা হলেন। আওয়াজ তুললেন। নেতৃত্ব দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তুমুল আন্দোলন হলো। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ব্যারাকে ফিরে যেতে বাধ্য হলো। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি ভোট পেল। পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সংসদ বসবে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, এমন একটি সময়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য কাজটি করলেন। তারা দেশ ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে সমাসীন না করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বড় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি পূর্ব পাকিস্তান শাসন করুন, আমি পশ্চিম পাকিস্তান শাসন করি। আপনার এ অঞ্চলে আসার দরকার নেই।
পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলার মানুষ বুঝতে পারলো পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাঙালির শাসন বা অধীনতা মেনে নেবে না- জনগণের ভোটের রায়কে তারা অস্বীকার করছে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে গলা টিপে মারছে। তারা কখনোই শাসনক্ষমতা বাঙালির হাতে ছেড়ে দেবে না। এই উপলব্ধি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে জাতিগত উপলব্ধিতে পরিণত হলো। পূর্ববাংলার মানুষ আত্মসম্মানবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলো।
শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে দল-মত নির্বিশেষে পূর্ববাংলার মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। শুরু হলো স্বাধিকার আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করা হলো। শেখ মুজিবের গ্রেফতার, পূর্ববাংলার নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপানো এবং আচমকা গণপ্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। সে কারণেই জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্থপতি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে।
চকিতে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শুরু হলো মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনানায়ক হলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী।
এ পর্যায়ে পাকিস্তানিরা হলো ‘হানাদার বাহিনী’। কারণ তারাই নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার পর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সশস্ত্র সংগ্রামে তথা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল।
পাকিস্তানিরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নেয়নি। তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। হাজার হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। শত শত পুল-কালভার্ট এবং মিল-কারখানা ধ্বংস করেছে।
স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে লড়াই আমরা শুরু করেছিলাম ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে, সে লড়াই শেষ হয় একই বছর ১৬ ডিসেম্বর। এ দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয় লড়াকু জনগণের কাছে। আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয় সূচিত হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয় লাভ করেছি।
বিজয় মহান, বিজয়ের সংগ্রাম মহত্তর। এই বিজয় লাভ করার জন্য আমরা জীবনপণ করেছিলাম। জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম। বহু দুঃখ, বহু কষ্ট, বহু রক্ত, বহু ত্যাগ ও বহু জীবনের বিনিময়ে এই গৌরবময় ও ঐশ্বর্যময় বিজয় আমরা অর্জন করেছি। আমাদের জন্য, আমাদের জাতির জন্য এবং অনাগত ভবিষ্যতের জন্য এ এক মহান দান- আল্লাহর দান।
যে জাতির ওপর আল্লাহ ত্যক্ত ও বিরক্ত, সে জাতিকে আল্লাহ কখনও স্বাধীনতা দান করেন না। আমাদের ওপর খুশি হয়ে মহান আল্লাহ স্বাধীনতা ও বিজয় দান করেছেন। আমরা জাতিগতভাবে মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ।
মুক্তিযুদ্ধকালে তথা মহান স্বাধীনতা আন্দোলনকালে আল্লাহর কাছে আমরা ওয়াদা করেছিলাম, যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশকে আমরা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সাজাবো। এখনও আমরা সেই ছোট্ট ওয়াদা পূরণ করতে পারিনি। হাজার হাজার পশু কোরবানি করে আমরা আল্লাহর অপার সাহায্য কামনা করেছিলাম। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন- অফুরন্ত সাহায্য।
মহান আল্লাহর অপার রহমতে এখনও আমরা স্বাধীনতার মুকুট মাথায় পরে আছি। বিজয়ের বেশে আছি। কিন্তু যদি আমরা ওয়াদামতো দেশকে না সাজাই, দেশের মানুষের সুখ, শান্তি, স্বস্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ না করি, যদি দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং দরিদ্রদের জীবন-মান উন্নতিকল্পে কাজ না করি, যদি অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করি, তাহলে খোদা না করুক একদিন এ স্বাধীনতা পরাধীনতায় পর্যবসিত হতে পারে। আমরা যেন কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহর বিরাগভাজন না হই। বিজয়ের যে মুকুট এখনও আমাদের মাথায় শোভা পাচ্ছে, তা যেন দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ