স্বাধীনতা বুকের ভেতরে সূর্য

স্বাধীনতা বুকের ভেতরে সূর্য

প্রচ্ছদ রচনা মার্চ ২০১৩

জুবাইদা গুলশান আরা

স্বাধীনতা! স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে শত শত বছরের সাধনা, অশ্রু, হাসি, সুখ-দুঃখ এবং বঞ্চনার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর ইতিহাস সুদূর অতীত থেকেই ক্ষমতার লড়াই আর দ্বন্দ্বে কণ্টকিত। আমাদের এই দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবী নামের গ্রহটির ভূগোলক দেখে বোঝা যায়, শক্তিশালী দেশগুলো বরাবরই দুর্বল দেশগুলোর স্বাধীনতা হরণ করেছে। লুণ্ঠন করেছে সম্পদ। মানুষকে পদানত করে তাদের নিজস্বতা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে। অনেক বছর আগে এ দেশের ওপর দিয়ে নানা জাতির আসা-যাওয়ায় বারবার তাদের জীবন বিপন্ন হয়েছে। শস্য শালিনী বাংলাদেশ আঘাতে আঘাতে মৃত প্রায় হলেও আবার শক্তিও সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়েছে। এক সময় সংস্কৃত ভাষা ছাড়া এ দেশে সাধরারণ মানুষের মুখের ভাষার ব্যবহার যেমন গুরুত্বহীন ছিলো, তেমনই সমাদরও ছিলো না। তখন বৌদ্ধ ধর্মগুরু ও পণ্ডিতেরা ধর্মীয় শ্লোক বা দোঁহা রচনা করেন। এই দোঁহাগুলোয় তারা ব্যবহার করেছেন এক ভিন্ন ভাষা যা সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলো এবং মানুষের সুখ-দুঃখ এতে ফুটে উঠতো। জ্ঞানের চর্চায় মানুষ তার ইচ্ছেকে এভাবেই ধর্মীয় ভাষার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাষায় সাজিয়ে পরিবেশন করেছে। যাকে আমরা বলতে পারি আদি বাংলা ভাষা। বহু বছর পরে একজন বাঙালি আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সুদূর নেপাল রাজদরবারে চর্যাপদের আদি রূপ চর্যা চর্যবিনিশয়ে আবিষ্কার করেন। নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরে প্রমাণিত হয় যে, চর্যাপদই হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপ। এতে যে জীবনচিত্র দেখা যায়, সেখানে এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, নৌকা, ফকির- সন্ন্যাসী, পদ্মফুল, পদ্মা নদীÑ এসবই ব্যবহার হয়েছে। সুখ দুঃখ, দারিদ্র্য ও নিপীড়ন সবই এ ভাষায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রচলিত ক্ষমতার যত আনাগোনা ঘটেছে, সাধারণ মানুষ তেমনই বহুবার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করেছে। ইতিহাস পড়লে জানা যায়, পাঠান, মোগল আধিপত্যের পরে এক সময়ে ব্রিটিশরা আসে ও ক্ষমতা দখল করে। তখনও সাধারণ মানুষ অবিরাম আন্দোলন করে। প্রায় দুশো বছর পর উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। আগেই বলেছি স্বাধীনতা পুরোপুরি পাওয়া খুবই কঠিন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আমাদেরকে দেয় দুটো স্বাধীন দেশ, ভারত ও পাকিস্তান। অনেক আশার স্বাধীনতা হলেও এ দেশের মানুষ সত্যিকার স্বাধীনতা পায়নি। তার জন্য হাজার হাজার টানাপড়েন, অবিশ্বাস আর অশান্তির পরে বোঝা গেল দুর্বলের প্রতি ক্ষমতাধর শক্তির নির্মমতাকে স্তব্ধ করতে হলে প্রতিরোধ ছাড়া উপায় নেই। আজকে ভাষার কথা বলছি। আসলে প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল বাঙালা ভাষার ওপরেই। সেই রক্তঝরা ফেব্রুয়ারির যুদ্ধ প্রমাণ করে দিলো দেশের প্রথম লড়াইটা ছিলো ভাষার লড়াই। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সমান অধিকার না পেলে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পেলে, শিক্ষার অধিকার না পেলে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। এমনি করেই এলো একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। রুখে দাঁড়ালো এ দেশের মানুষেরা। সে এক অবাক করা যুদ্ধ। ছাত্র-জনতার ওপরে, সাধারণ মানুষের ওপরে নেমে এলো প্রচ- আঘাত। একদিকে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও অন্য দিকে অস্ত্রবিহীন সাধারণ মানুষ। চাষাভূষো গ্রামের নিরীহ মানুষ, চাকরিজীবী, মুটে, মজুর সবাই প্রস্তুত হলো গেরিলা যুদ্ধের জন্য। বেশির ভাগ তরুণ দেশ থেকে ভারতে চলে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো। ভারত তখন বাংলাদেশকে সাহায্য করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ঘর শূন্য হয়ে গেল। কত তরুণ প্রাণ দিলো তার সংখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন যুদ্ধ ছিলো এক বিস্ময়কর ঘটনা! শেষ অবধি ষোলোই ডিসেম্বর এক রক্তের সমুদ্র পার হয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতা এমনই এক দুর্লভ ঐশ্বর্য যা পেতে হলে অশ্রু, রক্ত মিশে ত্যাগের কঠিন দুঃখ বুক পেতে নিতে হয়। আমাদের বাংলাদেশ ঠিক তাই করেছিল। তাইতো আমাদের পতাকার বুকে মানচিত্র ও সূর্যের তীব্র তেজ ও শক্তি বিচ্ছুরিত হয়। কত মানুষ ত্যাগ, তিতিক্ষা ও নিষ্ঠুর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মা-বোনের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এ দেশ, এ পতাকা। ইতিহাসের কাছে তাই বারবার এসে দাঁড়াই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলি, স্বাধীনতা যেন উত্তর প্রজন্মকে এনে দেয় সততা ও সৌন্দর্যের চিরজাগ্রত শক্তি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ