স্বাধীনতার অঙ্গীকার    -ড. এম এ সবুর

স্বাধীনতার অঙ্গীকার -ড. এম এ সবুর

প্রচ্ছদ রচনা মার্চ ২০১৮

প্রিয় বন্ধুরা! এখন কোন মাস? তোমরা নিশ্চয় বলবে স্বাধীনতার মাস! হ্যাঁ, মার্চ অবশ্যই আমাদের স্বাধীনতার মাস, সংগ্রামের মাস। অগ্নিঝরা মার্চ অন্যায়-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-বিদ্রোহের মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসেই আমাদের দেশের স্বাধীনতার ডাক আসে, শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এতে অংশ গ্রহণ করেন এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। পরে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত হয় স্বাধীন বাংলার সীমারেখা। আমরা লাভ করি লাল-সবুজের গৌরবময় পতাকা।
বন্ধুরা! ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলেও এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছে। এ যুদ্ধে ব্রিটিশ বণিকনেতা লর্ড ক্লাইভ, সরকারের মন্ত্রী মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগম প্রমুখ গোপন আঁতাত করে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহকে হারিয়ে দেয়। আর ব্রিটিশরা এ দেশের শাসনক্ষমতা দখলে নেয়। এতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা হারিয়ে ব্রিটিশের কাছে পরাধীন হয়। ব্রিটিশ লোকজন শাসন ক্ষমতা পেয়ে আমাদের দেশের সম্পদ-অর্থ লুটে নেয়ার সুযোগ পায়। তারা আমাদের দেশের বিশ্ববিখ্যাত মসলিন কাপড় উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এ সময় তারা জমিদারি প্রথা চালু করে এ দেশের কৃষকের জমি কেড়ে নেয়। আর কৃষকদের ধান-পাটের চাষাবাদ বন্ধ করে নীল চাষে বাধ্য করা হয়। তারা আমাদের দেশের অনেক মুসলমান-হিন্দুকে খ্রিস্টান বানায়। এ দেশের প্রচলিত অফিস-আদালতের ভাষা বাতিল করে ইংরেজি ভাষাকে চাপিয়ে দেয়। তারা আমাদের দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে তাদের গোলামি করার শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটায়। এ ছাড়া আমাদের দেশের মানুষের ওপর তারা অনেক অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। এসব কারণে এ দেশের লোকজন তাদের ওপর ক্ষেপে যায়। তারা ব্রিটিশদের অত্যাচার-নির্যাতন রুখে দাঁড়ায় এবং এ দেশের স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায়। এতে ব্রিটিশরা এ দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। তবু এ দেশের মানুষেরা হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, সূর্যসেন প্রমুখ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম-আত্মত্যাগ করেছেন। তাদের সংগ্রামের ধারবাহিকতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শোষণের নাগপাশ থেকে এ দেশ স্বাধীন হয়। তখন আমাদের দেশের নাম দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। আর বর্তমান পাকিস্তানের নামকরণ হয় পশ্চিম পাকিস্তান। তখন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে একদেশ ছিল। স্বাধীন দেশ পেয়ে এ দেশের লোকজন খুব খুশি হয়েছিলেন। তারা মুক্তির আশায় বুক বেঁধেছিলেন। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের জাতির আশা-স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। একদেশ হলেও তারা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য তৈরি করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। আমাদের দেশের বা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ও সম্পদ বেশি হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আমাদের ভাগে কম দিয়ে তারা বেশি নিত। চাকরি-ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের লোকজন কম সুবিধা পেত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সুবিধা বেশি ছিল। এসব বৈষম্যের কারণে আমাদের দেশের জনগণ প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। সর্বোপরি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার মোহে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। অধিকন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। যার ফলে ২৬ মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ডাক আসে। আর মুক্তির আশায় এ দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনতা সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে গ্রামের কৃষক, শহুরে শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী-চাকরিজীবীসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। শিল্পী-সাহিত্যিক, প্রবাসী-সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। এ ছাড়া অনেক তরুণ-কিশোরও অংশ নিয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। এভাবে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
প্রিয় বন্ধুরা! সবাইকে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা কম কঠিন নয়। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। স্বাধীনতা শুধু নিজের ভোগের জন্য নয়, অন্যকেও স্বাধীনতার সুযোগ দিতে হয়। অনেক সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে অর্জিত এ স্বাধীনতাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। অনেক কষ্ট-ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের লাল-সবুজের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে হবে। কোনভাবেই যেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা হারিয়ে না যায় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। এজন্য সবাইকে ভালোভাবে পড়ালেখা করতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে।
আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, এ দেশের মানুষের ইতিহাস জানতে হবে। বাবা-মা, শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সবাই মিলেমিশে একসাথে থাকতে হবে। মারামারি-বিবাদ-বিশৃঙ্খলা পরিহার করতে হবে। গরিব-দুঃখীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। আমাদের দেশীয় ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। বিদেশী-বিজাতি সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। আমাদের সামাজিক নিয়ম-নীতি মানতে হবে। বড়দের সম্মান আর ছোটদের ¯েœহ করতে হবে। দেশের সকল মানুষের অধিকার আদায় করতে হবে। মানুষে মানুষে বিভেদ-বৈষম্য দূর করতে হবে। একদিকে নিজে ভালো কাজ করতে হবে এবং অপরকেও ভালো কাজে উৎসাহিত করতে হবে। অন্যদিকে নিজেকে খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে হবে এবং অপরকেও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশের মানুষকে ভালো-বাসতে হবে। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। এতে আমাদের স্বাধীনতা সুসংহত হবে, দেশ উন্নত হবে, বিশ্বের বুকে আমাদের সম্মান বাড়বে। আর স্বাধীনতার মাসে এসব বিষয়ে সবাইকে অঙ্গীকার করতে হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ