স্মৃতির ফুলকুঁড়ি আবু সাহেদ সরকার

স্মৃতির ফুলকুঁড়ি আবু সাহেদ সরকার

তোমাদের গল্প অক্টোবর ২০১৬

ক্লাস ফাইভে পড়তাম তখন। আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু মিনারুল। সে আমার মতই সহজ সরল স্বভাবের। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মিনারুল ছিল তৃতীয়। ছোটবেলা থেকেই সে অভাব আর কষ্টের মাঝে বড় হয়েছে।
আমরা তখন প্রায় ১২তে পা দেবো। এক বিকেলে আমি মিনারুলকে বললাম চল ক্রিকেট খেলতে যাই। সে যাবে না বলে চলে গেল। তবু আমি ডাক দিয়ে হাত নেড়ে বললাম সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে আসতে। আমাদের একটা অভ্যাস ছিল একদিন মিনারুলের বাড়িতে আরেকদিন আমার বাড়িতে রাতে থেকে পড়াশুনা করা। আমার কথামত সন্ধ্যায় একটা বই হাতে আমার বাড়িতে উপস্থিত হলো মিনারুল। মাথাটা নিচু করে কণ্ঠটা গম্ভীর সুরে আমাকে বললো, সাহেদ তোকে একটা কথা বলবো। বল! উত্তর দিলাম। সে বলল আগামী শনিবারের মূল্যায়ন পরীক্ষার টাকা নেই। তখন আমার পারিবারিক অবস্থা মোটামুটি ভালোই ছিল। আমার বাবা সুগার মিলে মেকানিক্যাল ফিটার পদে চাকরি করতেন। আমার পরিবারে বড় দুই বোন এবং শেষ সম্বল আমাকে নিয়েই। পরীক্ষার ফি আমিই দেবো বলে মিনারুলকে সান্ত্বনা দিলাম। সে মাথা নেড়ে যেন সায় দিলো। রাতে বেশ জমিয়ে পড়াশুনা করলাম। মিনারুল আমাকে প্রশ্ন করে আবার আমি ওকে। পাড়ার সকলের চোখে লাগতো আমাদের বন্ধুত্ব। সবাই বলতো “ওমন বন্ধুত্ব কতদিন থাকবে?” শুনে দু’জনেই কষ্ট পেতাম। হাসি আর আনন্দের মাঝে বড় হয়েছি দু’জন। নিজে যা খেয়েছি মিনারুলকেও তাই খাইয়েছি, যেন দুইজন আপন মায়ের পেটের ভাই। মিনারুলও তাই ভাবতো। শনিবারের পরীক্ষায় আমরা সাফল্যের সাথে পাস করি। নীরবে বসে ভাবি যেন সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হতে থাকে। খাওয়ার সময় একসাথে বসে কতই না মজা করে খেতাম। এখনও স্মৃতিগুলো অন্তরে নাড়া দেয়।
মাস দুয়েক পর আমাদের সমাপনী বৃত্তি পরীক্ষা। আমাদের স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন সালাম স্যার। আমরা অঙ্কে কাঁচা ছিলাম বলে আমাদের আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করেছেন স্যার। স্যার আমাদের সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। কোন ছাত্র ক্লাসে না এলে সবাই বাড়িতে গিয়ে ধরে নিয়ে আসতাম তাকে। ক্লাসে না আসায় কান মুচড়ে দিতেন স্যার। সবাই হাততালি দিতাম। বেশ মজার মধ্যেই কাটছিল আমাদের ছাত্রজীবন। টিফিনের সময় সবাই মিলে কতই না খেলা খেলতাম হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, ব্রেঞ্চ ঠেলা, কলম টোকানো আরও কত কি? সে সব খেলা আর চোখেই পড়ে না। কয়েকদিন পরের ঘটনা, মঙ্গলবার ছিল সেদিন। টিফিনের সময় আমরা সবাই ক্লাসরুমের মধ্যে ব্রেঞ্চ দিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে মিনারুলের উহ আওয়াজ আমার কানে এসে বিঁধল। তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে দেখি সে মাটিতে পড়ে আছে। লতিফ তার হাত ধরে। ক্লাসের মেঝেটা পাকা থাকায় পড়ার সাথে সাথেই হাতটা ভেঙে যায় তার।
মিনারুলের দু’চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমিও যেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। লতিফ আমার পাশের গ্রামের। আমার ক্লাসের খুব ভালো একজন বন্ধুও বটে। হঠাৎ একটা সাড়া পড়ে গেলো আশপাশ গ্রামে। সবাই হইহুল্লোড় শুরু করে দিলো বিদ্যালয়ে। লতিফ আমাদের চুপ করিয়ে তার পাশের বাড়ির কবিরাজ কাশিম আলীর ছেলে এনামুল হকের কাছে নিয়ে যায়। কাশিম আলী একজন নামকরা হাড়ভাঙা কবিরাজ হিসেবে খ্যাত। তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা পিতার ঐতিহ্য রক্ষার্থে হাড়ভাঙা চিকিৎসালয় দিয়েছে। কবিরাজ এনামুল হক মিনারুলের হাত ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে দেয়। বেশ ক’দিন লাগলো হাতের ঘা শুকাতে। আমি লতিফকে নিয়ে পড়ার ফাঁকে দৌড়ে যেতাম মিনারুলের বাড়িতে। প্রায় ১ মাস অতিবাহিত হলো মিনারুল কিছুটা সুস্থ। সামনে সমাপনী পরীক্ষা খুব কষ্ট করে পড়ছে সে। এসময় পড়াশুনা ছাড়তেও পাড়ছে না। মিনারুলের বাড়ি থেকে পরীক্ষার সেন্টার নিকটে হতো। সে জন্য সন্ধ্যাবেলায় ওর বাড়িতে গিয়ে রাতে থেকে সকালে দু’জনে একসাথে যেতাম পরীক্ষা দিতে। সাফল্যের সাথে পরীক্ষা শেষ করলাম।
পারিবারিক চাপে মিনারুলের মধ্যে অভাবের কষ্ট নাড়া দিয়ে ওঠে। আমি যেন বুঝতে পারি তার আর্তনাদ। স্মৃতিঘেরা আমাদের শৈশবকাল কিভাবে কেটেছে তা আজ আমাকে কাঁদায়। আমাদের এতদিনের তিলেতিলে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব নিমিশেই শেষ হবে বুঝতেই যেন গা ঝিমঝিম করে ওঠে। স্মৃতির ফুলকুঁড়ি হঠাৎ শুকিয়ে যাবে ভাবতেই হাঁফ ছেড়ে উঠি। নিজেকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। এখনো সেই স্মৃতিগুলো আমাকে নীরবে কাঁদায়...।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ