হাসে বাঁকা চাঁদ

হাসে বাঁকা চাঁদ

গল্প সেপ্টেম্বর ২০১০

আহসান হাবিব বুলবুল

এত আবেগ, এত আনন্দ, এত উচ্ছ্বাস আর কখনো দেখিনি। এখানে সেখানে ছেলেমেয়েরা জটলা করছে। হেমন্তের শেষ বিকেলে প্রকাণ্ড সূর্যটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পাশ্চিমে ঢলে পড়ছে। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় অকাশ বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মেঘের পর মেঘ রঙের আবির মেখে যেন ছুটে চলেছে। লাল নীল আকাশটা যেন ছেলেমেয়েদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দিগন্ত জোড়া মাঠে শিশুদের সাথে সাথে বড়রাও নেমে এসেছেন। সবার দৃষ্টি পশ্চিমাকাশে। আজ ঈদের চাঁদ উঠবে। ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদকে হাসি ঠোঁটে স্বাগত জানাবে সবাই, ‘আহলান সাহলান ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক’ বলে। ঈদের চাঁদ দেখার এত আয়োজনে, প্রকৃতির বর্ণাঢ্য মেলায় কখন যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। অজানা-অচেনা ছেলেমেয়েদের ভিড়ে এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করি। খুব ভাল লাগে। ওরা না জানি আমার কত আপন, চির চেনা। ঢাকা শহর দালান-কোঠায় ঢাকা। আকাশ দেখা, খোলা মাঠে বেড়ানো সে তো অনেক কিছু। এক সময়ের মুক্ত মাঠ-ঘাট জলাশয় এখন নগর জীবনের কোলাহল আর ঘিঞ্জিতে পরিপূর্ণ। শুধু সোডিয়াম বাতির আলোর ঝলকানি। তারা ভরা আকাশ, জোৎস্না রাত এখানে স্বপ্নপুরীর রূপকথা। আর ঈদের চাঁদ দেখা? সেতো টেলিভিশনের পর্দায় চোখ মেলা। আজ কিন্তু আমার সে রকম মনে হচ্ছে না। আমি যেন বাস্তবে দাঁড়িয়ে আছি। খুব কাছাকাছি। হেমন্তের মেঘমুক্ত স্বচ্ছ আকাশ। কখনো সাদা মেঘের ভেলায় রাজ্যি পাড়ি দেয়া। বালিহাঁসের উড়ে যাওয়া। গাংচিলের ঘরে ফেরা। দিগন্তে বাতাসের কলতান। এ সবই যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। একটু দূরে ছেলেমেয়েরা হৈচৈ করে ওঠে। ঐ যে ওই দ্যাহা যায়, ঈদের নয়া চাঁদ। কাঁচির ফালির লাহান, ক্যামুন চিকোন। শিশুরা গাইছে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’ অনেকেই হাত তুলে পশ্চিমাকাশে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। তখনো আমার চোখে পড়েনি। আমার দু’চোখ আকাশে খুঁজে ফিরছে। : ভাইজান! আপনি মনে হয়, এ্যহোনও দ্যাহেন নাই। আমার আঙুলের দিকে তাক করেন। ঐ যে সাদা মেঘডার ফাঁহে দ্যাহা যাইতেছে। : হ্যাঁ দেখেছি। আমার দু’চোখ আলোয় আলোয় ভরে ওঠে। বাঁকা এক ফালি চাঁদে এত আলো বুঝি আর কখনো দেখিনি। ঈদ মোবারক!! ছেলেটি তখনো পাশে দাঁড়িয়ে। আপনি মনে হয় বড় বাড়ির ছেলে। গ্রামের ঈদ বারবার আইছেন। আমার নাম হাসু। হাসু মিষ্টি করে হাসে। : আমি আনু। তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। : তুমি পড় বুঝি? : হ’ কেলাস ফাইভে পাস দিছি। হাইস্কুলেও ভর্তি হইছি। তয় সবদিন স্কুলে যাওয়া হয় না। বাপজানের সাথে ক্ষ্যাতে কাজে যাইতে হয়। : কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। : আপনি কি পড়েন। : কাস সেভেনে পড়ি। : আমার এক কাস ক্ষতি গ্যাছে। নইলে আমিও এইভার সেভেনে পড়তাম : হাসু তোমাকে ঈদ মোবারক। কাল ঈদের মাঠে দেখা হবে। আমাদের বাড়ি এসো। তোমার বন্ধুদেরও নিয়ে এসো। : আইছ্যা। গ্রামে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। অনেক দিন মাইক ছাড়া অজান শোনা হয় না। দরাজ গলায় আজান। যেন প্রকৃতির মত নির্ঝর শুধু কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে। দূরে আনন্দ কোলাহল। বেশ কয়েক বছর পর আমরা এসেছি গ্রামে ঈদ করতে। আমার ছোট্ট বোন সাবা, ওর আগ্রহটাই বেশি। ওর কাছে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করার মজাটাই নাকি আলাদা। চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে ঘুুরে বেড়ানো যায়। হৈ-হুল্লোড় করা যায়। মেলায় যাওয়া যায়। নদী, পাখি, বন-বনানী কত কী দেখা যায়। আমি ওর কথায় সায় দিই। আমাদের আগ্রহ দেখে বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেন গ্রামেই ঈদ করবেন। ঈদের একদিন আগে আমরা গ্রামে এসে পৌঁছি। ঈদে বাড়ি আসতে পথে যে কত ধকল সহ্য করতে হয়। তারপরও আমাদর বাস জার্নিটা খুব উপভোগ্য হয়। প্রায় অর্ধশত গাড়ি এক সারিতে ছুটে চলে। সবাই ঈদে ঘরমুখী। মনে হয় একটা আনন্দ মিছিল। ঈদে বাড়ি যাওয়ার এক বিশাল লংমার্চ। অপরাহ্নের কিছু আগে আমাদের গাড়ির বহর যমুনা সেতুতে এসে ওঠে। বিরাট সেতু দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সাবা চিৎকার করে ওঠে এইতো আমরা এসে পড়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বাঘাবাড়ি বন্দরে এসে পৌঁছি। এখান থেকে বড়াল নদী দিয়ে নৌকায় গ্রামে যেতে হবে। আমাদের গ্রামের নাম সোনাপুর। ঠিক যেন সোনার মতই। নদীতীরে ছিমছাম, ছায়াসুনিবিড় একটি ছোট্ট গ্রাম। শীতকালে বড়াল নদীতে তখন পানি থাকে না। বর্ষার পানি নেমে গেলেও এখনো নৌকা চলার মত পানি আছে। তাই রিকশা বা ভ্যান গাড়িতে চাপতে হয়নি। আমরা সবাই মিলে নৌকা ভ্রমণটা বেশ এনজয় করি। গল্পে গল্পে অনেক রাত হলো। কথা আর শেষ হয় না। ঈদ উত্তেজনায় ভাই-বোনদের চোখে ঘুম নেই। নতুন পোশাক, ঈদের মাঠে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুদের মিষ্টিমুখ করানোÑ এই নিয়ে যত কথার ফুলঝুরি। ছোট চাচার ছেলে সিয়াম। ও ঈদের জামা কাউকে দেখাচ্ছে না। দেখালে পুরনো হয়ে যাবে। ওকে নিয়ে সবাই মজা করছে। আমি অবশ্য ইতোমধ্যেই একবার নতুন পোশাক পরে ফেলেছি। এই নিয়ে কাজিনদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। একে একে সবার চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে। পুরনো চিনা দেয়াল ঘড়িটার টিক-টিক-টিক-টিক শব্দ শোনা যায়। আনু! আনু! এ্যাই আনু ওঠ! ঈদের মাঠ দেখতে যাবি না? কী সুন্দর সাজিয়েছে! আলো আঁধারিতে সাজানো মাঠ। ... এত সুন্দর মাঠ! রঙবেরঙের নিশান আর বেলুনে ছেয়ে গেছে। পাশ দিয়ে কুলকুল রবে বয়ে যাচ্ছে নদী শিশিরে-শিশিরে ভিজেছে সবুজ ঘাস। পায়ে কেমন শীতল পরশ লাগছে। খালি পায়ে এসেছি। অনেকদিন খালি পায়ে নরম ঘাসের ওপর হাঁটা হয় না; বেশ লাগছে। পানু ভাইয়াটা যে কী! সাথে নিয়ে এসে কোথায় যে গেল। এখনই ভোর হবে। ঐ তো একদল ছেলে সাদা সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, হাতে সবুজ নিশান নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা তো আমাদেরই বাড়ির দিকে যাচ্ছে। হ্যাঁ ঐ তো হাসু! ওটা বুঝি হাসুরই দল। ... আম্মু ওদের সেমাই পায়েস মিষ্টি কত কী খেতে দিচ্ছেন। ছোট্ট ওই শিশুটির নাম কী? ও কেমন নিশান উঁচু করে ধরে আছে!া আম্মু ওকে একটা নতুন জামা পরিয়ে দিলেন। ওর দু’ঠোঁটের রাশি রাশি হাসি ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদের মত মনে হচ্ছে। শিশুটি কী মনে করে ওর হাতের নিশান আমাকে ধরিয়ে দিল। আমি নিশানটি উঁচু করে ধরলাম, আরো উঁচুতে। : আনু, সাবা তোমরা ওঠো! ভোর হয়েছে। ফজরের নামাজ পড়বে। ঐ বাচ্চাটা কে মা? : কার কথা বলছিস বাবা? : না। কি স-ব-স্ব-প্ন। ততক্ষণে খোলা জানালা দিয়ে ভোরের ফুরফুরে মৃদুমন্দ বাতাস আমাকে যেন জাগিয়ে তোলে ঈদের খুশিতে!!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ