হেমন্তের সোনালি রোদ্দুর

হেমন্তের সোনালি রোদ্দুর

প্রচ্ছদ রচনা নভেম্বর ২০১৩

জাকির আবু জাফর

সোনালি ধানে ভরা মাঠ। দিগন্ত বেয়ে যেখানে আকাশ এসে নেমেছে। যতদূর যায় চোখ ততদূরই ধানের জগৎ। ধানের পিঠে শুয়ে থাকে সোনারঙ মাখা আদুরী রোদ। কী কোমল! কেমন মায়াবী। সৌন্দর্যময় দৃশ্যের কল্লোলে যেমন ভরে যায় চোখ। তেমনি কোমল স্নিগ্ধতার সৌরভে ভরে যায় মন। সমস্ত হৃদয় জুড়ে জেগে ওঠে হেমন্তের মনোরোম দৃশ্যগুলি। বাংলাদেশের সোনার ঋতু হেমন্ত। সোনালি ধানে মাঠ ভরে থাকে তো থাকেই। রোদের রঙও সোনার মতো জ্বলতে থাকে দিনভর। একে সোনালি ঋতু না বলে কী আর বলা যাবে। কেনোই বা বলবো! আমাদের চোখ সাক্ষ্য দেয়। মন সাক্ষ্য দেয়। সাক্ষ্য দেয় হৃদয়ের গভীর অনুভূতি-হ্যাঁ, হেমন্ত ঋতু এক আনন্দময় মনোরম ঋতু। যাকে কতইনা অন্য সুন্দর জেগে ওঠে বাংলাদেশে। না শীত না গরম- নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশ এমন কথাই তো শুনেছি চিরকাল। না গরম না শীতের দেশে এখন তো প্রায় আট-নয় মাসই গরম তার প্রবল প্রভাব বিস্তার করে রাখে। গ্রীষ্মকালতো গরমেরই কাল। কিন্তু বর্ষা! বর্ষার তুমুল বৃষ্টিপাতের ভেতরও কি গরম কমে যায়? এর জবাব তো না। বৃষ্টি যেন কোনো ভাবেই গরমের প্রভাবকে পরাস্ত করতে পারে না। পারছে না। এখনতো আবার বর্ষায় বৃষ্টির দেখা মেলে না। ভরা বর্ষার আকাশ এখন আর খুব বেশি দেখাই যায় না। তবু আমাদের বর্ষা। তবু আমাদের শ্রাবণ মেঘের আকাশ। তবু আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বর্ষার এমন আকাশ থেকেই বেরিয়ে আশে শরৎ। শরৎ মানেইতো কালো মেঘগুলো সাদা হয়ে শিমুল তুলোর মতো উড়তে থাকে সারা আকাশময়। এ ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে নানান পরিবর্তন। বর্ষায় বৃষ্টি কম ঝরে বলে শরতে বেড়ে যায় বৃষ্টির দাপট। প্রায় সারা শরৎ জুড়েই থেকে থেকে বৃষ্টি হতে থাকে। বৃষ্টির জৌলুশে শরতের সাদা মেঘ আর সাদা থাকে না। তবে কাশফুলের সাদা সৌন্দর্য ধুয়ে নিতে পারে না বৃষ্টি। এভাবে বৃষ্টির ভেতর দিয়েই মুখ গোমড়া করে শরৎ পেরিয়ে যায়। যায় ধীরে। তখনো আকাশময় ছড়িয়ে থাকে শরতের পাখা। একরকম শরতের পাখায় ভর করেই উড়ে আসে আমাদের প্রিয় ঋতু হেমন্ত। নদীর তীরে কাশফুলের চুল তখনো দোল খেতে থাকে বাতাসে। তখনো আকাশভরা থাকে সাদা মেঘের পাখনায়। এর ভেতর দিয়েই ধীরে নিঃশব্দে প্রকৃতিতে প্রবেশ করে হেমন্তকাল। হেমন্তের বয়স বাড়তে থাকে। আর ধীরে ধীরে মেঘমুক্ত হতে থাকে বিশাল আকাশ। এক সময় মধ্য হেমন্তে গোটা আকাশ এক অখণ্ড নীলে ছেয়ে যায়। উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিম সারা আকাশ যেনো এক অখণ্ড নীলের বিছানা। এমন মেঘমুক্ত আকাশেই রোদ ওঠে। রাত্রি নামে। নামে সোনাঝরা বিকেলের নরম শরীর। সারা বাংলাদেশের সবুজ বৃক্ষরাজি আর মাঠভরা ধানের জগতে যেনো সোনালি রোদের ঘুমঘুম উপস্থিতি। আহা! কী আনন্দময়। গ্রামে এ সময়টা ছবির মতো জেগে থাকে সারা আকাশ এবং জমিনে। হেমন্তের দুপুর এক আশ্চর্য আনন্দে দুলে ওঠে আকাশের বুকে। তখন গোটা আকাশের কোথাও থাকে না। মেঘের ছানা পোনাও কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। যতদূর চোখ নেয়া যায় যতটা দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে পারে তার সবটাই আকাশ আর আকাশ। এমন আকাশ দেখে মন আর থাকে না মনের ঘরে। সেও যেনো ছুটে যায় আকাশের সেই নীল গভীরতার দেশে। এই তো আমার হেমন্তের দুপুর। তারপর ধীর পায়ে বিকেল প্রবেশ করে মাঠে ঘাটে এবং ঘাসের ভেতর। আহা সে কী কোমল রোদ, হৃদয়কে আনন্দের ভরিয়ে দেয়। শীতল করে বুকের জমিন। হেমন্তের সন্ধ্যাও এক অপরূপ আনন্দের রঙ ছিটিয়ে চলে যায় রাতের দিকে। বিশাল বিরাট অগ্নিগোলক সূর্যটা নিজেকে রক্তের মতো লাল করে অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তখন আকাশময় পাখিদের নীড়ে ফেরার দৃশ্য কার না ভালো লাগে। লাল সূর্যের বুক পেরিয়ে পাখিরা পৌঁছে যায় তাদের নীড়ে। কণ্ঠে গান থাকে পাখিদের। তারা যেনো গেয়ে যায় হেমন্তের মায়াবী সঙ্গীত। হেমন্তের রাতের কথা বলতে গেলে মনটা হু হু করে ওঠে। মেঘযুক্ত বিশাল রাতের আকাশ। এমন আকাশেই ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে রাতের ফুল তারারা। তারাদের মিটিমিটি জ্বলে ওঠার মুহূর্তগুলো যেমন আনন্দের, তেমনি মধ্যরাতে যখন আকাশের কোথাও তারাহীন থাকার অবকাশ নেই সেই সময়ের দৃশ্য সমস্ত হৃদয়কে উদ্ভাসিত করে তোলে। বিস্ময়ে বিভোর হয়ে ওঠে মনের পৃথিবী। দেখেই বলে চোখ- হায়! কী আনন্দের জগৎ জেগে উঠেছে আকাশের গায়ে। এত তারা এত নক্ষত্র ফুটে থাকে হেমন্তের রাতে। হেমন্তের জোছনা তো প্রায় দুধের মতো সাদা সুন্দরে ঝরে ঝরে পড়ে। সারা আকাশময় জোছনার প্রভাব এমনভাবে  ছড়িয়ে পড়ে দেখে মনে হয় দুধের জোয়ার জেগেছে বুঝি। ঝিরিঝিরি বাতাসে বয়ে যায় আলো। এমন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ছাতিম ফুলের সৌরভ। ছাতিমের গন্ধে হৃদয়-মন মুগ্ধতার আনন্দে স্পন্দিত হয়। ছাতিম ফুলও দেখতে প্রায় দূর নক্ষত্রের মতো মনে হয়। রাতের শরীরে সাদা আলোর মতো জ্বলে। শরতে শুরু হয়ে হেমন্তেও ফোটে শিউলি ফুল। শিউলির গন্ধও বয়ে নিয়ে যায় রাতের বাতাস। এক জায়গার ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয় সমস্ত জায়গায়। এক দিকের ঘ্রাণ চৌদিকে। এ তো জীবনেরই আরেক বহমানতা। জীবনেরই অন্য সুন্দর। যাকে আয়োজন করে সোনার ঋতু হেমন্ত। হেমন্তের সকাল আরো স্নিগ্ধ আরো কোমল। আরো প্রাণময় সুন্দর। রাতভর ঝরে পড়া শিশিরে ভেজা থাকে সকালের শরীর। ঘাসের মুখে মুক্তার মতো জমে থাকে শিশিরের ফোটাগুলো। তাকে সকালের নরম রোদ স্পর্শ করে। অমনি সেই শিশিরের ফোটাগুলো জ্বলে ওঠে মুক্তার মতো। ঘাসে ভরা সারা মাঠে চিকচিক করে হাজার হাজার মুক্তোর শিশির। পাতায় ফুলে পাঁপড়িতে জেগে থাকে শিশিরের শীতল ফোটা। স্পর্শ করলেই সারা শরীরে শিহরীত হয় এক ধরনের কোমল পরশ। হেমন্তের এ আনন্দ আর কোথাই বা আছে পৃথিবীর? আছে আমার এই বাংলাদেশে। আমার এই মাঠে। আমার বৃক্ষময়। আমার নীলে লীলায়িত আকাশে। হেমন্তের এমন সুন্দর গৌরব আমি করবোই। আমি গাইবোই হেমন্তের জয়গান। মেঠো পথের হেমন্ত অথবা মেঠো পথে এক অন্য আকর্ষণে ভরা থাকে। মেঠো পথে ময়লা কাদা শুকিয়ে বেশ খানিকটা চলার উপযোগী হয়ে ওঠে। হেঁটে যায় পথিক মেঠোপথ ধরেই। যেতে যেতে কতরকম সৌরভের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। বুনোফুলের গন্ধে ভরে থাকে পথ। কোথাও কোথাও চেনা ফুলের ঘ্রাণ। আবার কোথাও পথের ধারে ফুটে থাকে আকন্দফুল। সাদা অথবা বেগুনি আকন্দফুলের মুখে কালো ভোমরের উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য মনকে ভরিয়ে তোলে। প্রকৃতি এভাবে সাজিয়ে রাখে জীবনকে। জীবনের সৌন্দর্যকে। হেমন্ত ঋতুর হয়ে এসব দৃশ্য জেগে থাকে বাংলাদেশের বুকে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ